এক নজরে আর্জেন্টিনার ২০২২ বিশ্বকাপ জয়

ফুটবল দুনিয়া December 18, 2023 1,059
এক নজরে আর্জেন্টিনার ২০২২ বিশ্বকাপ জয়

সৌদি আরবের বিপক্ষে হোঁচট খেয়ে কাতার বিশ্বকাপের শুরু আর্জেন্টিনার । মেসিদের সামনে গ্রুপপর্বের ম্যাচগুলো যেন পরিণত হয়েছিল নকআউটে। অবশ্য বীরের মতোই শেষ ষোলোতে পা রেখেছিল আলিবিসেলেস্তেরা। তারপর কোয়ার্টার, এরপর…! গল্পটা সবার জানা। ফ্রান্সকে হারিয়ে বিশ্বকাপের শিরোপা জিতে নেয় লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা। দীর্ঘ ৩৬ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ট্রফি উঁচিয়ে ধরতে লিওনেল স্কালোনির শিষ্যদের কম চড়াই-উতরাই পেরোতে হয়নি।


বাদ পড়ার শঙ্কা থাকায় আলবিসেলেস্তে ভক্তদের বেড়েছিল আতঙ্ক, ‘এই বুঝি বাজল বিদায় ঘণ্টা’। মাঠে প্রতিটা ম্যাচ নক আউটে রূপ নিলেও আকাশী-নীলরা শেষ পর্যন্ত পাশার দানটা মিলিয়ে দিয়েছেন। কণ্টকাকীর্ণ পথ পেরোনোর কত শত গল্প। অঘটনের হারে শুরু করা বিশ্বকাপে শিরোপা উঁচিয়ে থামল আর্জেন্টিনা। স্মৃতির রোলার কোস্টারে চড়িয়ে সেই গল্পেই থাকছে গ্রুপপর্ব থেকে ফাইনালের প্রতিটি ম্যাচের খুঁটিনাটি।


সৌদি আরবের গ্রুপ পর্বের অঘটন

ততক্ষণে ফুটবল পাড়ায় ‘গেল গেল রব উঠে গেছে’, আর্জেন্টিনা কিনা শেষে সৌদির মত একটা দলের কাছে আটকে গেল। মেসির বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন ও টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ড নিয়েও তখন কাঁটাছেড়া। ২-১ গোলের হারে স্কালোনির শিষ্যরা যেনো ভেঙেচুরে চুরমার। এশিয়ার দেশটির জয়টিকে অঘটনই বলা চলে। তাছাড়া অফসাইডের ফাঁদে ভালো করেই পড়েছিল লিওনেল মেসিরা।


অফসাইডের পতাকা না তুললে ফল হয়ত ভিন্ন হতো। লুসেইল স্টেডিয়ামে গ্রুপ ‘সি’র খেলার পেনাল্টি থেকে দলকে এগিয়ে দেন মেসি। ৪৮ মিনিটে সৌদি ফরোয়ার্ড সালেহ আল-শেহরি আনেন প্রথম গোল, ৫৩ মিনিটে মিডফিল্ডার সেলিম আল-দাসারি বাড়ান লিড। সেটিই নির্ধারণ করে দেয় ম্যাচের। হারের পর লিওনেল মেসি জানান, এভাবে শুরু চাননি তিনি। এমন হার শিরোপা জয়ের মিশনে ‘চরম আঘাত’ জানিয়ে বলেছিলেন, ‘এই হারটা কষ্ট দিচ্ছে।’


মেক্সিকোকে হারিয়ে আশায় বাঁচা

ততক্ষণে অনেকে খাতা-কলম নিয়ে বসে গেছেন। কেউ কষছেন, কিভাবে বাদ পড়বে অন্যতম ফেভারিট দলটি। কারও কামড়ানো কলমে লেখা হচ্ছে কোনো মতে পরের রাউন্ড নিশ্চিতের ক্ষীণ সম্ভাবনা। হম্বিতম্বির শেষ ছিল না মেক্সিকোর, ইতিহাস-পরিসংখ্যান ঘেটে তারাও ছিল প্রত্যয়ী। তবে এক মেসির সামনে শেষ হয়ে গেল মেক্সিকানরা। ২-০ গোলের জয়ে আসরে টিকে থাকার ৩ পয়েন্ট সংগ্রহে আনে আলবিসেলেস্তেরা। দুরন্ত মেক্সিকোর বিপক্ষে ৬৪ মিনিটে মেসির গোলের পর ৮৭ মিনিটে এনজো ফের্নান্দেজের গোলে আসে পূর্ণ তিন পয়েন্ট।


পোল্যান্ডকে নিয়ে শেষ ষোলো

গ্রুপ টেবিলে তখনও ভয়ানক চাপে মেসির আর্জেন্টিনা। গ্রুপের শেষ ম্যাচে পোল্যান্ডকে হারাতেই হবে, এর বাইরে আর কোনো সমীকরণ নেই। হারলে বিনা বাক্যব্যয়ে বিদায়, ড্র করলেও তাকিয়ে থাকতে হবে মেক্সিকো-সৌদি ম্যাচে। এমন চাপে থাকা ম্যাচেও ভক্তদের আশাহত করেননি মেসি-আলভারেজরা।


একই দিনে একই সময়ে গ্রুপের চার দলের খেলা। প্রত্যেকের সামনেই নকআউটে ওঠার সুযোগ। মেক্সিকোর বিপক্ষে জেতায় অবশ্য আর্জেন্টিনার জন্য সমীকরণটা আগের থেকে খানিকটা সহজ হয়েছে। তবুও সব হিসেব-নিকেশ একদিকে রেখে জয়ের বিকল্প ভাবতে পারছে না আর্জেন্টিনা। নক আউটে রূপ নেয়া ম্যাচে শুরুতেই পেনাল্টি মিস করে বসলেন মেসি।


কিন্তু ফুটবলের দেবতা ততক্ষণে নাটক জমিয়ে রেখেছেন। আধিপত্য রেখে আর্জেন্টিনা জিতে গেলে ২-০ গোলে। ৪৬ মিনিটে ম্যাক অ্যালিস্টারের পর ৬৭ মিনিটে ব্যবধান দ্বিগুণ করেন জুলিয়ান আলভারেজ। সি-গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন হয়ে শেষ ষোলো নিশ্চিত করে আলবিসেলেস্তেরা। আরেক ম্যাচে সৌদিকে হারিয়েও গোল পার্থক্যে বাদ পড়ে মেক্সিকো। আর্জেন্টিনার সঙ্গী হয় রবার্ট লেভান্ডোভস্কির পোলিশবাহিনী।


শেষ ষোলোর নক আউটে অস্ট্রেলিয়া

এই হলে সেই হতো—টাইপের আলোচনা ততদিনে বন্ধ। শুরুর পর থেকে নক আউটের ফাড়ায় পড়া আর্জেন্টিনাও যেনো নিজেদের মানিয়ে নিয়েছেন। হারলেই গুটাতে হবে তল্পিতল্পা, এমন সমীকরণের ম্যাচে তাই নির্ভার ছিল স্কালোনির শিষ্যরা। এশিয়ার দেশ হিসেবে খেলা অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দেয় ২-১ গোলের ব্যবধানে, নিশ্চিত করে নেয় কোয়ার্টার ফাইনালের টিকিট।


পঞ্চমবারের মতো বৈশ্বিক আসরে খেলতে আসা মেসি প্রথমবারের মতো পায় নকআউট পর্বে গোল, ক্যারিয়ারের হাজারতম ম্যাচে বিশ্বকাপে গোলের হিসেবে ছাড়িয়ে যান কিংবদন্তি ডিয়েগো ম্যারাডোনাকে। কিন্তু উদযাপনে একেবারেই মিয়ম্রাণ মেসি। জয়ের পর ক্যারিয়ারের হাজারতম ম্যাচ নিয়ে বাড়তি উচ্ছ্বাস নেই কেন মেসির? এমএলটেনের সাফ জবাব, ‘না, একদম না। উদযাপনের সময় আসেনি।’ হয়ত আর্জেন্টাইন মহাতারকা আগেই জানতেন, ‘কিছু তো একটা হচ্ছে, সময় আরও বাকি!’


কোয়ার্টার ফাইনালে শক্তিশালী ডাচ দূর্গ

কাতার বিশ্বকাপে সবচেয়ে বিতর্কিত বললেও ভুল হবে না আর্জেন্টিনা-নেদারল্যান্ডসের ম্যাচটি। কার্ডের বন্যা বয়ে যাওয়া খেলাটি রূপ বদলেছে বারবার। আকাশী-নীল নাকি কমলা, কোন রঙে রঙিন হবে কাতারের সর্বাধিক ধারণ ক্ষমতার লুসেইল স্টেডিয়াম—নির্দিষ্ট দল বাদে নিরেট ফুটবল সমর্থকদের কাছে জানতে চাইলেও তখন কারো নাম বলার সাধ্যি ছিল না। নির্ধারিত সময় গড়িয়ে অতিরিক্ত সময় হয়ে টাইব্রেকার, সেখানে ‘বাজপাখি’ খ্যাত এমিলিয়ানো মার্টিনেজের দর্শণীয় সব সেইভ। ফলাফল শেষ চারের লড়াইয়ে উঠে গেছে আর্জেন্টিনা, প্রতিপক্ষও নিশ্চিত—রাশিয়া বিশ্বকাপের রানার্স আপ ‘জমাট রক্ষণের’ ক্রোয়েশিয়া।


রোমাঞ্চে ভরপুর শেষ আটের ম্যাচটি কার্যত অর্থে চুইয়ে চুইয়ে ফেলেছে রোমাঞ্চ। ম্যাচে লিওনেল মেসি গোল করালেন, সফল স্পট কিকে খুঁজে পেলেন জাল। জয়ের পথেই ছিল আর্জেন্টিনা। শেষদিকে সবকিছুতে বাগড়া দিলেন নেদারল্যান্ডসের বদলি নামা ওউট ওয়েঘর্স্ট। জোড়া গোল করে ছড়ালেন রোমাঞ্চ। অতিরিক্ত সময়ে গড়ানো নাটকীয়তাও থামল ২-২ ব্যবধানে। শেষ পর্যন্ত গেল টাইব্রেকারে। নায়কোচিত মার্টিনেজে ৪-৩ ব্যবধানে জিতে স্বপ্ন ছোঁয়ার আরেকটু কাছে যায় আর্জেন্টিনা।


ক্রোয়েটদের বিপক্ষে একপেশে সেমির লড়াই

অথচ সেমির লাইন আপটা ভিন্নরকম হতে পারত। ক্রোয়েশিয়া বনাম আর্জেন্টিনা না হয়ে হতে পারত ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা। সেটি না হওয়ায় ফুটবলে উত্তাপ কিছুটা কমেছে বটে! লুসেইলের সুবিশাল স্টেডিয়ামও দেখেছে অনেকটা একপেশে আক্রমণ আর গোলের ৩-০ ব্যবধানের ম্যাচ। পঞ্চমবারের মতো ফাইনালে উঠে মেসির তো আনন্দ ধরে না, শিশুর মত নাচলেন। আলবিসেলেস্তেরা ড্রেসিংরুমে গাইলেন, ‘ব্রাজিল কোথায়, ব্রাজিল কোথায়’।


টিটের শিষ্যদের অবশ্য বাড়ির পথ দেখিয়ে দিয়েছে ক্রোয়েটরা। শেষ আটের লড়াইয়ে জমাট রক্ষণ আর গোলরক্ষকের অসামন্য পারফর্মে ভেদ করা যায়নি ক্রোয়েট দূর্গ। অতিরিক্ত সময়ে দর্শনীয় গোলে নেইমার দলকে এগিয়ে দিলেও শেষ সময়ে শোধ দিয়ে ম্যাচ টাইব্রেকারে নেয় লুকা মদ্রিচের দল। সেখানে আরেকবার দেওয়াল তুলে রাখেন ক্রোয়েট গোলরক্ষক ডমিনিক লিভাকোভিচ, টাইব্রেকারেই নিশ্চিত হয় ব্রাজিলের বিদায়। ফাইনালে ওঠার মঞ্চে ক্রোয়েটদের নিয়ে গোলউৎসবে মাতে আর্জেন্টিনা।


মেসির রেকর্ডময় রাতে গোলমুখে শট রাখার প্রত্যয় দেখায় স্কালোনির শিষ্যরা। বিশ্বকাপে সর্বাধিক ম্যাচ খেলার কীর্তি গড়ার দিনে মেসি পান গোল। ১১ গোল করে স্বদেশি কিংবদন্তি গাব্রিয়েল বাতিস্তুতাকে ছাড়িয়ে নিজেকে নিয়ে যান শীর্ষে। ম্যাচে আনেন একটি সহায়তাও। মেসিময় দিনে লাতিন ছন্দে ইউরোপের দলটি হারে ৩-০ গোলে। ২০১৪ সালের পর ট্রফির নিশ্বাসের দূরত্বে যাওয়ার সুযোগ আনতে মেসির পাশাপাশি বাকি দুটি গোল করেন তরুণ আলভারেজ।


ফাইনালে ফরাসি দুর্গের পতন এবং মহাতারকার হাতে মহা ট্রফি

রোলার কোস্টারে শঙ্কা নিয়ে চলা কাতার বিশ্বকাপের শেষটা সবচেয়ে বেশি মধুর করেছেন লিওনেল মেসি। বিশ্বকাপেও আর দেখা যাবে না সর্বকালের অন্যতম সেরা এই তারকাকে। ২০১৪ সালে ব্যর্থ হলেও এবার আর সুযোগ হারালেন না। গোল সংখ্যা বাড়িয়ে নিয়ে নিজেকে নিয়েছেন অন্যন্য উচ্চতায়। মরক্কোকে হারিয়ে ফাইনালে আসা আগেরবারের চ্যাম্পিয়নদের থেকে ছিনিয়ে নিলেন শিরোপা, স্বপ্নের ট্রফি।