মুসলিম জাহান এর প্রধান দুইটি ধর্মীয় উৎসব এর মধ্যে একটি হলো “ঈদ-উল-ফিতর” আর অন্যটি হলো “ঈদ-উল-আযহা”। আন্তরিকতা ও সদ্ভাব এর এক সীমাহীন আনন্দ উপোভোগের সুযোগ প্রতি মুসলমানের জীবনে বছরে এই দুবারই আসে। সকল রাজা বাদশা, ধনী গরীব সকলে কাধে কাধ মিলিয়ে দুই রাকাত সালাত আদায় করে একে অপরের মাঝে সকল ভেদাভেদ ভুলে যায়। সৌদি আরব সহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে আজ যথাযথ মর্যাদার সাথে পালিত হচ্ছে ঈদ উল আযহা। আর বাংলাদেশ সহ দক্ষিন এশিয়ার অধিকাংশ দেশে আগামীকাল ১৩ সেপ্টেম্বর ঈদ উল আযহা পালিত হবে।
ঈদ উল আযহা কে আমরা কুরবানীর ঈদ হিসেবে উল্লেখ করে থাকি। পবিত্র আল কুরআনে ‘কুরবানী’ এর পরিবর্তে ‘কুরবান’ শব্দটি ব্যাবহৃত হয়েছে। তাছাড়া হাদিসেও কুরবানীর পরিবর্তে ‘উযাহিয়া’ ও ‘যাহিয়া’ শব্দটি ব্যাবহৃত হয়েছে। একারণেই একে ‘ঈদ-উল-আযহা’ বলা হয়ে থাকে।
কুরবানীর ইতিহাস অনেকদিনের পুরোনো। সর্বপ্রথম কুরবানীর প্রচলন ঘটে আদম (আঃ) এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিল এর দ্বারা। সে সময় তৎক্ষণাৎ বোঝা যেত কার কুরবানী কবুল হয়েছে আর কার কুরবানী কবুল হয়নি। হাবিল ও কাবিল দুজনই একটি বিশেষ কারণে কুরবানী করে। কিন্তু হাবিলের কুরবানী কবুল হওয়ায় এবং কাবিল এর কুরবানী কবুল না হওয়াতে কাবিল রাগে ও ক্ষোভে হাবিল কে হত্যা করে। হাবিল ই ছিলো সর্বপ্রথম মৃত মানুষ।
হযরত ইব্রাহীম (আঃ) হলেন মুসলিম জাতির পিতা। সূরা হজ্জ এর ৭৮ নম্বর আয়াতে তাকে মুসলিম জাতির পিতা হিসেবে ঘোষনা করা হয়েছে। মুসলমানদের উপর কুরবানীর যে নিয়ম প্রচলিত আছে তা হলো মুলতঃ ইব্রাহীম (আঃ) দ্বারা তার শিশু পূত্র ঈসমাইল (আঃ) কে আল্লাহর উদ্দেশ্যে কুরবানী দেয়ার অনুসরণে “সুন্নতে ইব্রাহীম” হিসেবে প্রচলিত রয়েছে।
মক্কা নগরীর মিনা প্রান্তরে আল্লাহর দুই নিবেদিত বান্দা ইব্রাহীম ও ঈসমাইল নিঃশর্ত আত্নসমর্পনের মাধ্যমে তুলনাহীন ত্যাগের যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন সেটিরই স্মৃতিচারণ হচ্ছে এই ঈদ-উল-আযহা বা কুরবানীর ঈদ। ইসলামের এক মহান নিদর্শন এই কুরবানী যা “সুন্নতে ইব্রাহীম” হিসেবে মহানবী (সাঃ) প্রতিবছর মদিনায় তা পালন করতেন। পরবর্তী সময়ে সাহাবীগণও নিয়মিতভাবে এটি পালন করেছেন।
কুরবানী কুরআন সুন্নাহ দ্বারা সুপ্রমাণিত একটি বিষয়। কাফির মুশরিকরা মূর্তি পূজা করে। দেবদেবীদের পুজা করে। তাদের দেবদেবীকে উৎসর্গ করে বিভিন্ন পশু বলিদান করে থাকে। তাদের এহেন কর্মকান্ডের প্রতিবাদ স্বরূপ মুসলমানদের উপর আল্লাহর উদ্দেশ্যে সালাত আদায় ও কুরবানীর হুকুম দেয়া হয়েছে।
সূরা হজ্জ এর ৩৬ ও ৩৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে “এবং কা’বার জন্যে উৎসর্গিত উটকে আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন করেছি। এতে তোমাদের জন্য মঙ্গল রয়েছে। সুতরাং সারিবদ্ধভাবে বাঁধা অবস্থায় তাদের যবেহ করার সময় তোমরা আল্লাহর নাম উচ্চারণ কর। অতঃপর যখন তারা কাত হয়ে পড়ে যায় তখন তা থেকে তোমরা আহার কর এবং আহার করাও যেসব অভাবগ্রস্ত চায় এবং যেসব অভাবগ্রস্ত চায় না তাদেরকে। এমনভাবে আমি এগুলোকে তোমাদের বশীভূত করে দিয়েছি,যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। এগুলোর গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না,কিন্তু তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের মনের তাকওয়া। এমনভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের বশ করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা আল্লাহর মহত্ত্ব ঘোষণা কর এ কারণে যে, তিনি তোমাদের পথ প্রদর্শন করেছেন। সুতরাং (হে নবী আপনি) সৎকর্মশীলদের সুসংবাদ দিন।” মহানবী (সাঃ) বলেছেন, “সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কুরবানী করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়”।
এসব কিছু থেকে পরিলক্ষিত হয় এসব যেনো কুরবানীর গুরুত্বকেই ফুটিয়ে তুলছে।
মানুষ তার সবচেয়ে প্রিয় বিষয় আল্লাহর রাস্তায় কুরবানী করতে রাযী আছে কি না সেটি পরীক্ষারই বিষয়। কুরবানীর ঈদ তথা ঈদ-উল-আযহা হযরত ইব্রাহীম (আঃ), বিবি হাজেরা ও পূত্র ঈসমাইল (আঃ) এর অসামান্য ত্যাগের স্মৃতি বিজরিত উৎসব। তবে আমাদেরকে এখন আর ইব্রাহীম (আঃ) এর মত পূত্র কুরবানীর মত ত্যাগের মুখোমুখি হতে হয় না। একটিও হালাল পশু কুরবানী করে আমরা এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারি। মানুষ কুরবানীর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে চায়।
এসব চেতনায় উজ্জীবিত হয়েই আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, “তোরা ভোগের পাত্র ফেলরে ছুড়ে, ত্যাগের হৃদয় বাঁধ”। সকলের জন্য রইলো ঈদ-উল আযহার শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক।