চাকরি বলতে বোঝায় নির্দিষ্ট বেতনের বিনিময়ে অপরের কাজ করা বা কর্মে নিযুক্ত হওয়া। এটা ব্যক্তির উপার্জনের মাধ্যম এবং তার পেশাগত পরিচয় বলে গণ্য হয়। নিজ মেধা, যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুযায়ী চাকরির মাধ্যমে জীবিকা উপার্জন করা ইসলামে স্বীকৃত- যদি না তার সঙ্গে কোনো অবৈধ অনুষঙ্গের সংশেস্নষ না থাকে।
হজরত মুসা (আ.) মাদইয়ানে অবস্থানকালে হজরত শোয়ায়েবের (আ.) কর্মে নিযুক্ত হয়েছিলেন বলে আল কোরআনে উল্লেখ আছে। (সূরা আল কাসাস : ২৬-২৮)।
রাসূলুল্লাহর (সা.) জীবদ্দশায় এবং খোলাফায়ে রাশিদিনের খেলাফতকালে বিশিষ্ট সাহাবিরা রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছিলেন, যার বিনিময়ে তাদের নির্ধারিত হারে বেতন দেয়া হতো।
হজরত ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহর (সা.) যুগে (রাষ্ট্রের) কাজ করেছি; তাতে তিনি আমাকে বেতন দিয়েছেন। চাকরিতে নিযুক্ত ব্যক্তিকে সাধারণত কর্মকর্তা বা কর্মচারী বলে অভিহিত করা হয়।
চাকরির বৈধ ক্ষত্র : চাকরির মাধ্যমে উপার্জন বৈধ হলেও তা সব চাকরির ক্ষত্রে প্রযোজ্য নয়। যদিও চাকরিজীবী ব্যক্তি শ্রমের বিনিময়ে উপার্জন করে থাকে তথাপিও কিছু কিছু ক্ষত্রে চাকরি করা ইসলামে অনুমোদিত নয়। যেমন : সুদি কারবারের লেখক হিসেবে চাকরি করা বা মাদকদ্রব্য প্রস্তুতকরণ, পরিবহন, পরিবেশন- এ জাতীয় কাজ ইসলামে হারাম করা হয়েছে।
এরূপ কাজে চাকরি গ্রহণ করলে এর উপার্জন ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ নয়। চাকরির উপার্জন বৈধ হওয়ার জন্য চাকরির ক্ষত্রটিও ইসলাম সমর্থিত হওয়া আবশ্যক।
কর্মকর্তা-কর্মচারীর কর্তব্য : চাকরিতে নিয়াগকালে নিয়োগকর্তা কর্তৃক কোনো লিখিত বা মৌখিক শর্তারোপ করা হলে তা পালন করা কর্মকর্তা-কর্মচারীর ওপর অবশ্যকর্তব্য। কেননা, এটা এক ধরনের চুক্তি, যার মাধ্যমে সে তা পূরণ করার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়।
ইসলামের বিধানে অঙ্গীকার পূরণ করা কর্তব্য। আল্লাহ বলেছেন, ‘ওহে যারা ঈমান এনেছ! তোমরা অঙ্গীকারগুলো পূরণ কর। (সূরা আল মায়িদা : ১)।
নিয়োগকর্তা বা ঊর্ধবতন কর্তৃপক্ষর আনুগত্য করা ও তাদের বৈধ নির্দেশ পালন করা কর্মকর্তা-কর্মচারীর ওপর অবশ্যকর্তব্য। আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আনুগত্য কর রাসূলের এবং তোমাদের দায়িত্বশীলদের। (সূরা নিসা : ৫৯)।
চাকরি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নিয়োগকর্তা এবং ঊর্ধবতন কর্তৃপক্ষ দায়িত্বশীল হওয়ায় তাদের আনুগত্য করা আল্লাহর এ বাণী দ্বারা আবশ্যক সাব্যস্ত হয়। অবশ্য দায়িত্ব বহির্ভূত কোনো কাজের নির্দেশ দেয়া হলে তা পালন করা ওয়াজিব নয়; কেননা, তা দায়িত্বভুক্ত নয়। আবার অন্যায় কাজে তাদের আনুগত্য করাও আবশ্যক নয়।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কোনো পাপ কাজে কারও আনুগত্য নেই; আনুগত্য শুধু ভালো কাজে।’ (বোখারি মুসলিম)।
এরূপ পরিস্থিতিতে আনুগত্যের পরিবর্তে সাধ্যমতো তা প্রতিহত করা কর্তব্য হয়ে যায় বলে অন্য হাদিসে উলেস্নখ রয়েছে। তবে যদি পাপকাজে বা অন্যায়ে এমনভাবে বাধ্য করা হয়, যা থেকে বাঁচার আর কোনো পথ থাকে না তাহলে এর নৈতিক দায় তাদের ওপর বর্তায় না।
চাকরিসংশ্লিস্ট নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তা-কর্মচারীর কর্তব্য। ইচ্ছাকৃতভাবে দায়িত্বে অবহেলা করা ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ নয়। কেননা, এতে উপার্জন বৈধ হয় না; অথচ উপার্জন হালাল হওয়া ফরজ এবং হারাম উপার্জনের পরিণতি জাহান্নাম। কর্তব্যে অবহেলা বিভিন্নভাবে হতে পারে।
যেমন : বিনা ওজরে অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করা, কাজে দীর্ঘসূত্রতা বা অযথা সময়ক্ষপণ, নির্ধারিত সময়ে কর্মে অনুপস্থিতি বা বিলম্ব, সেবাপ্রার্থীদের সেবা প্রদানে গাফিলতি, হকদারদের হক আদায় না করা কিংবা হয়রানি করা প্রভৃতি। কর্তব্যে অবহেলার জন্য প্রত্যেককে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল; আর তোমরা প্রত্যেকেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (বোখারি)।
ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতি : চাকরিজীবীদের প্রায় সবারই কমবেশি ক্ষমতা থাকে। অবস্থান ও পদক্রমানুসারে ক্ষমতার পরিধির তারতম্য থাকলেও নিজ নিজ ক্ষত্রে প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু দৃশ্যমান কিংবা অদৃশ্যমান ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ থাকে।
এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কোনো কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে।
ফলে স্বেচ্ছাচারিতা, অর্থ-সম্পত্তি আত্মসাৎ, ভীতি প্রদর্শন ও হয়রানি, অন্যায়ভাবে স্বার্থসিদ্ধি প্রভৃতি সংঘটিত হয়। এসব কাজ ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম।
আত্মসাৎ দুই ধরনের হতে পারে- নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষর সম্পদ আত্মসাৎ এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে বা প্রভাব খাটিয়ে সাধারণ মানুষের সম্পদ আত্মসাৎ। দুটিই হারাম। আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না।’ (সূরা নিসা : ২৯)।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমরা তোমাদের কাউকে কোনো কর্মে নিযুক্ত করার পর সে যদি একটি সূচ বা তদপেক্ষা সামান্য বস্ত্তও আমাদের থেকে গোপন করে, তাহলে তাও আত্মসাৎ বলে গণ্য হবে, যা নিয়ে সে কেয়ামত দিবসে উপস্থিত হবে।’ (মুসলিম)।
নিয়োগকর্তা বা ঊর্ধবতন কর্মকর্তা যেসব সম্পদ ব্যবহার করার সাধারণ অনুমতি প্রদান করে তা ব্যবহার করা বৈধ। যেমন : অফিসের কাগজ-কলম, সরঞ্জামাদি, ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহারের জন্য কোনো বস্ত্ত প্রভৃতি। তবে তাতেও মিতব্যয়ী হওয়া উচিত।
চাকরিজীবী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এমন কারও কাছ থেকে উপহার গ্রহণ বৈধ নয়, যার সঙ্গে তার কর্তব্যের সংশ্লিস্টতা থাকায় তাকে কর্তব্য পালনে প্রভাবিত করার সংশয় বিদ্যমান থাকে।
রাসূলুল্লাহ (সা.) এক ব্যক্তিকে জাকাত আদায়কারী কর্মকর্তা নিয়াগ করেছিলেন। জাকাত আদায়ান্তে তিনি ফিরে এসে কিছু সম্পদকে তার প্রাপ্ত উপহার হিসেবে উপস্থাপন করলেন। এতে রাসূলুল্লাহ (সা.) অসন্তুষ্ট হয়ে তাকে কঠোরভাবে ভৎর্সনা করেছিলেন।
এ জাতীয় উপহার প্রকৃতপক্ষ উপহার না হয়ে ঘুষে পরিণত হয় এবং তা দুর্নীতির বিসত্মার ঘটায় বিধায় ইসলাম এর অনুমোদন দেয় না। এভাবে সেবাপ্রার্থীদের ফাইল আটকে রেখে অর্থ দাবি করা বা ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে কারও ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করাও ইসলামের দৃষ্টিতে মহা অন্যায়। এগুলো জুলুম; আর জুলুম হারাম।