সপ্তাহে ৫ দিন চাকরী। ২ দিন ছুটি। মাত্র বিশ্ববিদ্যলয় জীবন শেষ করলাম। আগে ক্লাসে ঘুমাতাম; এখন বোর্ডরুমের এসি খেয়ে খেয়ে লেদার কুশন মোড়া সোফাতে ঘুমাই আর উইকি ব্রাউজ করি। আর ছুটির ২ দিন এর একদিন যায় এক বন্ধুকে মাস্টার্সের ম্যাথ পড়াতে; আর আরেকদিন যায় স্কুল আর কলেজের বন্ধুগুলোর মাথার বারোটা বাজাতে।
সপ্তাহের অন্য শনিবারগুলোর মত আজকেও অর্ণবকে ম্যাথ পড়াতে গেলাম। অনেকদিন ধরে চিনি; শুধু পড়ানো না; সাথে প্রচুর গল্পও হয়; আর তার সাথে উপরি পাওয়া আন্টির হাতের গাজরের হালুয়া (ইয়াম্মিইইইইইই ;) এরকম গাজরের হালুয়া পেলে পড়ানো কে ছাড়ে??) । পড়াশুনার ফাকে ফাকে আমাদের বিভিন্ন বন্ধুদের নিয়ে গল্প হচ্ছিলো; সবাই undergrad শেষ করে এখন মাস্টার্স অথবা চাকরীতে ঢুকে গেসে। গল্পগুলো বন্ধুদের ক্রমাগত হতে থাকা বিয়ে অথবা প্রেমের দিকে শিফট করে গেলে সে বলে উঠলো, "আজকাল প্রেম করাটা স্ট্যাটাসের ব্যাপার হয়ে গেসে। সাথে কেউ না থাকলে ইজ্জ্বতের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়।"
কথাটা অনেকাংশে সত্য। প্রচুর ছেলেমেয়ের সাথে আমাদের ২ জনেরই পরিচয় থাকার সুবাদে এরকম ঘটনা ২ জনেই দেখেছি। ৭৫% ই এরকম। তবে আমি এখনো প্রেম নামের এই আজব জিনিসে বিশ্বাস করি কারন আমার কপালে কিছু আজব কাপল এর সত্যিকারের প্রেমকাহিনী দেখার সৌভাগ্য হয়েছে।
মোঘল আমলে সম্রাট শাহজাহান তার প্রেমের স্মৃতি অমর করে রাখতে তাজমহল বানিয়েছিলেন। আমি তাজমহল দেখেছিলাম যখন তখন ভেবেছিলাম, "মানুষ কতটা "ইয়ে!!" তখন মনে হয় ক্লাস ফাইভে পড়তাম। ১০ বছর পরে আবিরকে দেখে আমি বুঝতে পারলাম; প্রেমে পড়লে মানুষ তাজমহল বানানো তো ছার; চান্দেও হাসিমুখে পাড়ি দিতে পারে।
আবির আমার ছোট্টবেলার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুগুলোর একটি। মহা ট্যালেন্টেড ও মাল্টিপারপাস ফাজিল। যেকোনো সুশীল উক্তিকে অশ্লীল বানাতে ওর কোনোই জুড়ি ছিলো না। আবির , ফারজানা, রাকিব আর আমি; আমরা চারজন আমাদের undergrad জীবন একসাথে যেভাবে কাটিয়েছি বলার মত না। আমি, আবির আর রাকিব স্কুলের বন্ধু; স্কুল থেকে বেরোনোর পরেও বন্ধুত্ব ঠিকই আগের মত অমলিন ছিলো। আর ফারজানা , আমাদের গ্রুপের "the queen", সেই নারী যার জন্য আমাদের আবির 180 ডিগ্রি চেঞ্জ হয়ে ভালো ছেলে হয়ে গেলো। তাদের পরিচয়ের কাহিনী আমার নিজের চোখে দেখা। ওদের পরিচয় আমাদের সবার HSC এর পরে; ভর্তি পরীক্ষার আগে। গ্রামীণ ফোন এবং জিপিএ ৫ এর সংবর্ধনার সুবাদে ( তাও ভালো, GP এর নেটওয়ার্ক ইন্টারনেটের দিকে বাজে হলেও এই দিকে তাও এদের জীবনে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে!!)। ৪ জন ভর্তি পরীক্ষার শেষে চার দিকে; আবির আই ইউ টি তে; আমি বুয়েটে, রাকিব মেডিকেল আর ফারজানা ল তে ভর্তি হলো। প্রতি মাসে একবার করে সবার দেখা; সরকারী ছুটি পেলেই আবির আর রাকিবের ঢাকার বাইরে থেকে আগমন ও আমাদের সবার একসাথে আড্ডাবাজি। আমি আর রাকিব "da trop", দুটি গোলাপের মাঝে ২টি কাটা; আর ওরা প্রেমে মশগুল।
আমি একসময়ে প্রেমে বিশ্বাস করতাম না। এদেরকে দেখার পরে শুরু করেছি। সত্যিকার প্রেম জীবনে আসলে কোনো ছেলে কিভাবে ভালোর জন্য পরিবর্তন হতে পারে তার খুবই বড়ো উদাহরণ আবির। একসময়ে "শালাটারে" অশ্লীল জোকসের কারনে পিটাইতে ইচ্ছা করতো। কিন্তু ফারজানার স্পর্শে কি হলো জানিনা; তার স্বভাবের মধ্যে এরকম কিছু পরিবর্তন আসলো যে আমি ব্যক্তিগত ভাবে তাকে অনুকরণ করা শুরু করলাম। Undergrad এর কয়েক বছরে এই "ইয়ে" টার ধারেকাছে থেকে জীবনে কিছু ভালো গুন আমার ভিতরে আসছে বলে আমি আজকে গর্ব করতে পারি।
সবসময়ই সে ভালো ছাত্র ছিলো; কিন্তু ফারজানা আসার পরে সে অনেক সিরিয়াস হয়ে গেলো। ফলশ্রুতি; ডিপার্টমেন্টে খুবই ভালো রেজাল্ট। অন্যরা বলে , সে পড়াশুনা করেছে তাই। আমি আর রাকিব বলতে ভালোবাসি, "না, সে ভালোবেসেছে, তাই।"।
আমি আর রাকিব ২ জনেই মনে হয় আমাদের undergrad জীবনের সবচাইতে ভালো সময় এদের সাথে কাটিয়ে এসেছি। একসাথে আড্ডা দেয়া, CNG চড়া, বইমেলা অথবা চটপটি; অথবা এরাবিয়ানস এ আড্ডা; অথবা রাত্রে শপিং মলে ওদের টুকিটাকি কেনার ছলে ঝলমলে পথ ধরে হাটা; কখনো ওদেরকে ঈর্ষা করা অথবা কখনো ২ জনের ২ জনের প্রতি devotion দেখে শ্রদ্ধায় মাথা নত করা... এভাবে খুবই সুন্দর ভাবে ৪ টা বছর একসাথে পার করার সৌভাগ্য আমরা অর্জন করেছি।
ফারজানা ব্যারিস্টারি পড়া কমপ্লিট করার জন্য লন্ডন যাওয়ার পরে আবিরকে দেখে কস্ট হতো। প্রচন্ড মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে ওকে তখন যেতে দেখেছি। ফারজানা চলে যাওয়ার পরে আমরা স্কুলের বন্ধুগুলো একসাথে বরিশালে যাওয়ার সময় নদীর বুকে তারাভরা রাতে "মুরগী ও চিলের" জোক্সগুলো করার ফাকে ফাকে তার বিষন্নতা আমরা অনেকেই খেয়াল করেছিলাম।
অন্য অনেকে হয়ত বা তথাকথিত 'ফিজিবিলিটী' এনালাইসিস করে তাদের ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তা করতে পারত। আর আবির এখানে থাকলে অনেক কিছুই করতে পারত। কিন্তু সে তা করেনি। আমরা অবাক গর্ব নিয়ে দেখলাম, যখন চয়েসের প্রশ্ন এসেছে, সে সবকিছু ছেড়ে তার ভালবাসাকে চুজ করেছে। অর্ধেক পৃথিবী ভালোবাসার ডাকে পাড়ি দেয়ার কথা আমরা সবাই গল্পে শুনে থাকি; কিন্তু আমি আজকে গর্ব করে বলি আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুগুলোর একটা সেটা করেছে। কি পরিমান সংগ্রাম সেখানে তাকে করতে হয়েছে আর হচ্ছে; তা শুনলে প্রচন্ড কস্ট হয়। কিন্তু সবকিছুর পরেও তার কাছে যখন জিজ্ঞাসা করি; "তুই কি সুখী?" সে বলে,"যতক্ষন পর্যন্ত ও আছে, ততক্ষন পর্যন্ত, যেখানে যাবো সেখানে ভালো থাকবো, যেভাবে থাকবো না কেনো ভালো থাকবো।"
ওদের সাথে যখনই কথা বলি ভালো লাগে। এদের মত মানুষগুলো জানে যে চার অক্ষরের শব্দটার মধ্যে কি পরিমাণ অপরিমিত শক্তি লুকিয়ে আছে। এরা জানে যে কিভাবে ভালোবাসতে হয় আর কিভাবে অন্যকে ভালোবাসা শেখাতে হয়।
রাকিব আর আমি মনে হয় এই দুইজনের কাছে চির ঋণী থাকবো। এরা আমাদেরকে শিখিয়েছে কেউ কাউকে ভালোবাসলে কোন পর্যায়ে ভালোবাসতে হয়। হ্যাঁ, হয়ত বা আমি closet romantic. হয়ত বা আমি একটা মহা গর্দভ পর্যায়ের একটি মানুষ; কিন্তু এদের কারনে আমি অনেক কিছুর উপরে বিশ্বাস ফিরে পেয়েছি; আর এই পাওয়াটাই আমার জন্য অনেক বড়ো একটা অর্জন।
যেখানেই থাকিস না কেনো, ভালো থাকিস। সবসময় পাশে আমরা ছিলাম, আছি আর থাকবো।