মতিন সাহেব ইজি চেয়ারে বসে বসে দোল খাচ্ছেন আর মিটিমিটি হাসছেন। কখনও কখনও তার হাসি বিশ্বজয়ী হাসির লেভেলে চলে যাচ্ছে।
হাসির মূল কারণ তার হাতে থাকা মোবাইল ফোনটি। যে ফোনটিতে কিচ্ছুক্ষণ আগেই তিনি টেলিটকের অপরাজিত সিম ঢুকিয়েছেন! তিনি হাসছেন আর মোবাইল ফোনটির ওপর কোমলভাব হাত বুলাচ্ছেন। এমনভাবে হাত বুলাচ্ছেন যেন এটি কোনো মোবাইল ফোন না, হীরের টুকরো!
মতিন সাহেব একজন পুরুষ হয়েও কীভাবে এই অপরাজিতা সিমটি পেলেন, সেটা একটা ছোটখাটো ইতিহাস। আর এই ইতিহাসটা জানতে হলে একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে।
বউয়েরা সারাক্ষণ স্বামীর কাছে কোনো কিছুর আবদার নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করে এই সামাজিক ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে কদিন ধরেই মতিন সাহেব তার বউয়ের কাছে একটার আবদার নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করে আসছিলেন। জ্বি পাঠক, আপনি মেধাবী বলে ব্যাপারটা সহজেই ধরতে পেরেছেন। মতিন সাহেব তার বউয়ের কাছে একটা অপরাজিত সিমের আবদার করেই ঘ্যানঘ্যান করে আসছিলেন। কিন্তু মতিন সাহেবের বউয়ের একটাই কথা।
জীবন থাকতে তিনি তাকে এই অপরাজিত সিমটি তুলে দেবেন না। কারণ সিমটা তুলে দিলে মতিন সাহেব নিশ্চিত সারাদিন নেটে ডুবে থাকবেন, নেটে থেকে মেয়েদের সঙ্গে চ্যাটিং করবেন কিংবা ইয়ে ধরনের ভিডিও ডাউনলোড করে দেখবেন।
কিন্তু মেয়েদের মন অতি নরম বলেই হয়তো মতিন সাহেবের স্ত্রীর মনও একটা সময় গলে গেল। তবে সেটা শর্তসাপেক্ষে। শর্তটি হল, মতিন সাহেব এই সিমটি হাতে পাওয়ার পর থেকে কোনোদিন এই বাসার টিভিতে ভারতীয় সিরিয়াল ছাড়া অন্যকিছু চলবে না!
মতিন সাহেব ভাবলেন, এই সোনার ডিম দেয়া হাঁসের মতো অপরাজিত সিমটি তার কাছে থাকলে তার আর টিভির সামনে যাওয়ার সময়ই হবে না। এটা ভেবে প্রফিট লস বিবেচনা করে তিনি রাজি হয়ে গেলেন।
বর্তমানে ফিরে আসা যাক। মতিন সাহেব ইজি চেয়ারে বসে বসে এখনও দোল খেয়েই যাচ্ছেন আর মিটিমিটি হাসছেন। কিছুক্ষণ পরই তিনি তার মোবাইলে অপরাজিতা সিম থেকে নেটে ঢুকবেন। উত্তেজনায় তার হাত কাঁপছে... শরীরে শিহরণ বইছে...কী হয়... কী হয়... এই সিম নিয়ে তার কতশত জল্পনা-কল্পনা ছিল, আজ তা বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে।
মতিন সাহেব কাঁপাকাঁপা হাতে অপরাজিতা সিমের ডাটা কানেকশনটি অন করলেন। তারপর দুরুদুরু বুকে ফেসবুক অ্যাপ-এ ক্লিক করলেন! উত্তেজনাবশত কারণে হোক আর যেই কারণে হোক ঠিক সেই মুহূর্তেই প্রকৃতি তাকে করুণ সুরে ডেকে উঠল!
তিনি প্রকৃতির ডাক উপেক্ষা করতে পারলেন না। মোবাইলটা কোনোরকম বিছানার ওপর ফেলে রেখেই তিমি ওয়াশরুমের দিকে ছুটে চলে গেলেন।
প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়া শেষ করে তিনি রুমে ফিরলেন প্রায় ২০ মিনিট পর। রুমে ফিরেই ধড়ফড় করে তিনি তার মোবাইল ফোনটা হাতে নিলেন। এবং যেটা
দেখলেন, সেটা দেখার জন্য তিনি মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না! যে দৃশ্যটি স্বয়ং ঘোস্ট এফএমের রাসেল ভাইও বিশ্বাস করবেন না! মতিন সাহেব দেখলেন, ফেসবুক অ্যাপটির মাঝখানে এখনও একটি গোল বৃত্ত আপন মনে ঘুরপাক যাচ্ছে! অর্থাৎ ফেসবুক পেজটি বিশ মিনিটেও ওপেন হয়নি! এখনও ‘লোডিং’ চলছে!
মতিন সাহেব রাগে-দুঃখে মোবাইল ফোনটি আছাড় মারতে যাবেন, ঠিক সেই মুহূর্তেই ফেসবুক পেজটি ওপেন হল। তিনি রাগে ফুসতে ফুসতে নিউজফিড স্ক্রল করতে লাগলেন। ঠিক তখনই কোনো এক নিউজপোর্টালের একটি শিরোনাম ভেসে আসল তার নিউজফিডে! শিরোনামে লেখা- ‘অপরাজিত সিমের এ কেমন পরাজয়?’
মতিন সাহেব সঙ্গে সঙ্গে নিউজ লিংকে ঢুকলেন। এবং দেখতে পেলেন, মোবাইলের ওপরের দিকে আবারও একটি বৃত্ত আপন মনে ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে! মতিন সাহেব রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ঘরের দেয়ালে ঝুলে থাকা ঘড়ির দিকে মনোনিবেশ করলেন।
ঠিক ৯ মিনিট পর সেই ‘ঘুরন্ত’ বৃত্তটি থামলো এবং নিউজলিংকটা ওপেন হলো! তিনি নিউজটা পড়তে শুরু করলেন। সেখানে লেখা- ‘অপরাজিত সিমের এই ৮ টাকা জিবির অফারটি চলবে শুধুমাত্র প্রথম তিন মাস। তার পর থেকেই এই সিমের ডাটা চার্জ রেগুলার সিমের ন্যায়
কার্যকর হবে...’
মানুষ অতি শোকে পাথর হয়, মতিন সাহেব অতি শোকের সঙ্গে রাগের সংমিশ্রণের কারণে পুড়ে যাওয়া লাল পাথরের মতো হয়ে গেলেন। তিনি কি এখন ফোনটা আছাড় মারবেন? নাহ! এ হতে পারে না। তিনি এতটা বোকা নন। তার ফোন তো কোনো অন্যায় করেনি, সে তো কোনো গুটিবাজি করেনি, তবে সে কেন শাস্তি পাবে?
মতিন সাহেব আবারও কাঁপা কাঁপা হাতে মোবাইল ফোনের ব্যাকপার্টটা খুললেন। তারপর ব্যাটারি খুলে ‘অপরাজিত’ সিমটি বের করে আনলেন এবং এক চাপে মট করে সিমটাকে ভেঙে দুই টুকরো করে ঘরের জানালা দিয়ে ফেলে দিলেন!
অপরাজিত সিমটাকে শেষমেশ পরাজিত করতে পেরে তিনি আপাতত এক ধরণের প্রশান্তি লাভ করছেন। তিনি আবার গিয়ে তার ইজি চেয়ারটায় বসলেন। এই অপরাজিত সিমের জন্য বউয়ের হিন্দি সিরিয়াল দেখতে হবে, আপাতত এই দুশ্চিন্তা তাকে ভাবাচ্ছে না। একটু দূরেই দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখে মিটিমিটি হাসতে থাকা বউয়ের চেহারাখানা দেখলে সেই চিন্তা ভাবাতো কিনা, সেটা অবশ্য বলা যাচ্ছে না!
তথ্যসূত্রঃ বিচ্ছু, দৈনিক যুগান্তর