লিস্টের অন্যতম সুন্দরী মেয়ে যেদিন নক করে বলেছিল, ‘কথাটা আপনি কিভাবে নেবেন জানি না, তবে সত্য এই যে আমি আপনাকে ভালোবাসি’—ঠিক তখন ইনবক্স সিন করার মুহূর্তে আমি প্লেটের কোনায় ডিম রেখে আলু মাখিয়ে ভাত খাচ্ছিলাম। আবার একই মেয়ে কয়েক দিন পর যখন রেগেমেগে ব্লক মারল, তখনো আমি এক বন্ধুকে বলছি, ‘দোস্ত, একটা ডিম হবে? কাল দিয়ে দেব।’
জীবনে প্রথম যে রান্নাটা করেছি, সেটা হচ্ছে ডিম ভাজি। ডিম ভাজতে গিয়েই তেলের সঙ্গে ভুলে পানি মেশানোর কারণে রান্নাজীবনে প্রথম হাত পুড়িয়েছি। ‘তোমারে দিয়া কিচ্ছু হবে না, বেটার বাড়িতে গিয়া হালচাষ করো’—এই লাইনটা স্যারের মুখ থেকে শুনে আসার পর আরাম করে ডিমের কুসুম ভেঙে গরম ভাতের সঙ্গে মিশিয়ে কাঁচা মরিচ চিবিয়ে ভাত খেয়েছি।
কিছুই না পড়ে যাওয়ার পরও আন্দাজে কয়েকটা সঠিক উত্তর দেওয়ায় ম্যাডাম যেদিন সব দাঁত বের করে বলেছিলেন—‘বাহ! ছেলেটা তো পড়ে আসছে দেখি।’ সেদিন পরীক্ষায় যাওয়ার আগে তড়িঘড়ি করে একটা ডিম সিদ্ধ করে খেয়ে গেছি। জীবনে প্রথম যেদিন ছিনতাইকারী বুক বরাবর ছুরি ধরে বলেছিল, ‘যা আছে বাইর কর, নইলে কইলজা ফুটা কইরা দিমু।’ সেদিনও বাজারের ব্যাগের মধ্যে একডজন ডিম ছিল। জীবনে প্রথম মারামারি লাগাইছিলাম এক ডিম ব্যবসায়ীর ছেলের সঙ্গে। হাসপাতালবাসের সময় প্রতিদিন সকালে একটা করে সিদ্ধ ডিম মাগনা পাওয়া যেত। আবার গায়ে খানিকটা অ্যালার্জি থাকার কারণে ডাক্তার কর্তৃক অসংখ্য নিষেধাজ্ঞার মধ্যে ডিম নিষিদ্ধ হয়েছে সবার আগে।
জীবনে প্রথম সাফল্য ছিল ঝোপের মধ্যে একটা পুরোপুরি ঠিকঠাক হাঁসের ডিম আচমকা খুঁজে পাওয়া। জীবনে প্রথম ফেসবুকীয় হুমকি ছিল, ‘আমারে চিনস? তোরে কিন্তু ডিম-থেরাপি দিমু।’
বাবার মুখে প্রথম তিরস্কার হিসেবে শুনেছি, ‘মুরগিও তো ডিম পাড়ে। তুমি তো কিছুই করতে পারো না।’ আবার বাবার মুখে প্রথম প্রশংসা শুনেছি, ‘বাহ! আমার ছেলের গায়ের রং ডিমের মতো সুন্দর।’ জীবনে সবচেয়ে বেশি যে ধমক স্যার কর্তৃক খেয়েছি সেটা হচ্ছে, ‘খাতাজুড়ে ঘোড়ার ডিম লেখছস?’
কোনো তরকারি না খেতে চাইলে আম্মা যে কমন ধামকি দিতেন সেটা হচ্ছে, ‘যেটা আছে সেটা চোখ বন্ধ কইরা খাবি। তোর লাগি হাতির ডিম রান্না করতে পারব না।’ জীবনে সবচেয়ে বেশি যে শিক্ষণীয় গল্প শুনছি সেটা হচ্ছে, ‘কৃষকের সোনার ডিম পাড়া হাঁসকে কেটে ডিম বের করা।’ জীবনে সর্বশেষ ঋণ করেছি এক বন্ধুর কাছ থেকে ডিম ধার করে। একই সূত্রে সবচেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছি ডিম ধার দিয়ে।
রাত বারোটা, বিকেল ৫টা, সকাল ৭টা...এ ধরনের বেসময়ে লাগা বেয়াদব ক্ষুধা নিবৃত্ত করার জন্য একমাত্র ভরসা হিসেবে ডিমের দিকে হাত পড়েছে। এই জীবনে সবচেয়ে বেশিবার ম্যাচের কাঠিতে আগুন ধরিয়েছি ডিম ভাজতে গিয়ে। জীবনে সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটা ভেঙেছি, সেটা হচ্ছে ডিম। সবচেয়ে বেশি যে জিনিস নিয়ে দামাদামি করেছি, সেটাও হচ্ছে ডিম। যে জিনিস নিয়ে সবচেয়ে বেশি ভেবেছি, সেটা হচ্ছে ‘ডিম আগে না মুরগি আগে।’ যে শব্দটা কানে স্বস্তির আওয়াজ তোলে, সেটা হচ্ছে ডিম ভাজার ‘চ্যাররররররর’ শব্দ।
ডিম আমাদের মগজে, ডিম আমাদের কলিজায়, ডিম আমাদের হূদয়ে, ডিম আমাদের উদরে... আমরা ব্যাচেলর, আমরা ডিমে বিশ্বাস করি। আমাদের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসজুড়ে ডিমের অবস্থান। দুই দিন ডেট করা প্রেমিকাকে তিন নম্বর দিনে ছেড়ে দিই, আমরা ডিম ছাড়তে পারি না। আমরা কাঁধের ওপর নিঃশ্বাস ফেলা বন্ধুকেও বিশ্বাস করি না, কিন্তু ডিমকে বিশ্বাস করি। আমরা ‘সারা জীবন পাশে থাকব’ কমিটমেন্ট করা দুনিয়ার সবচেয়ে ভালো মানুষটার ওপর ভরসা করতেও ভয় পাই, কিন্তু ডিমের ওপর আমাদের আজন্ম ভরসা। বাজারের হাজার রকম দামি খাবার আমাদের হাতের পাশে না এলেও ডিম আমাদের সঙ্গেই থাকে। আমাদের পৃথিবী ডিমময়। ক্রিকেট মাঠকে ডিমের মতো মনে হয়, জিম, টিম, ভিম, হিম...ইত্যাদি শব্দ আমরা প্রায়ই ভুল করে ডিম পড়ি...আফ্রিদির মুখ দেখলেই ডিমের কথা মনে পড়ে, পরীক্ষার খাতায় খারাপ সময়ের সাক্ষী হয় এই ডিম। লুথার কিংয়ের বিখ্যাত ভাষণ—‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’কে আমরা শুনি ‘আই হ্যাভ এ ডিম’। মাঝেমধ্যে ইচ্ছা করে প্রেমিকাকেও গভীর আবেগ নিয়ে বলি, ‘যদি চোখের আড়াল হও, কাছে কি বা দূরে রও, মনে রেখো আমিও ছিলাম...এই ডিম তোমাকে দিলাম।’ এমন হাজারটা প্রেমিক আছে, যাদের প্রেমিকারা যদি বলে, কোনটা চাও? আমি না ডিম? হয় আমি থাকব, নয় ডিম থাকবে! প্রেমিক মুখ নিচু করে বলবে, ‘বইন, স্বামী-সন্তান নিয়া সুখে থাইকো, শান্তিতে থাইকো। আলবিদা।’