-"উফ্...ওই পোলা এইভাবে মায়ের পেডে কেউ লাত্থি মারে? মায়ের বুঝি কষ্ট লাগে না?"
গভীর মমতায় নিজের ফুলে ওঠা পেটে হাত বুলাতে বুলাতে কথাগুলো বলে কুসুম।মুখে একটা প্রশ্রয়ের ভাব নিয়ে কান খাড়া করে অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে তার পেটের দিকে।তার গর্ভের সন্তান কি বলে তা শোনার জন্য।এটা তার একটা খেলা।গত ক'মাস ধরে সে নিয়মিত এই খেলা খেলে আসছে।সে আপন মনে তার ছেলের সাথে কথা বলে।তার ছেলেও তার সাথে কথা বলে।কুসুম এখনও উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে তার ছেলের মুখ থেকে কিছু শোনার জন্য।
কোন উত্তর পায় না সে।
-"কিরে ব্যাটা কথা বলস না ক্যান?রাগ হইছস্?না ভুখ লাগছে? লাগারইতো কথা।সকাল থাইক্যাতো তোরে কোন খাওন দেই নাই।কেমনে দিমু?
সকাল থাইক্যাতো আমি নিজেই কিছু খাই নাই। তুই খাইবি কোন থাইক্যা?"
আপন মনে কথা বলতে থাকে কুসুম।এবার আধশোয়া থেকে আস্তে আস্তে উঠে বসে সে।ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই সকালের ছেলেটাকে দেখতে পায় সে।ছেলেটা ওর থেকে একটু দূরে ওভারব্রিজটার একটা রেলিঙের পাশে বসে আছে।তার সামনে দুইটা প্যাকেট রাখা।সকালে যখন কুসুম মগবাজারের এই ফুটওভারব্রিজটার উপর আসে তার কিছুক্ষণ পর সে ছেলেটাকে দেখে।ছেলেটা এখন যেখানে আছে সেখান থেকে বসে বসে তাকে দেখছিল।আর কুসুম যতবারই তার গর্ভের সন্তানের সাথে কথা বলছিল ততবারই সে মিটিমিটি হেসেছে।দুপুরে কুসুম আর ছেলেটাকে দেখেনি।এখন আবার প্যাকেট দুইটা নিয়ে বসে আছে।সকালে তার হাতে প্যাকেটগুলো ছিল না।
কুসুমের এখন প্রায় সাড়ে আটমাস চলছে।সে জানে না তার গর্ভের সন্তান ছেলে না মেয়ে।কিন্তু সে ধরেই নিয়েছে তার ছেলেই হবে।তার একটা ছেলের খুব শখ!
Md Sobuj Ahmed - MYsmsBD
তার একটা ছেলে আছে।সে যখন তার আদরের ধন সোনার টুকরা ছেলেটাকে ঘরে একা রেখে বাথরুমে গোসল করতে গিয়েছে তার বাবুটা তখন তারস্বরে চিৎকার করছে।সে গোসল রেখে ভেজা কাপড়েই দৌঁড়ে বের হয়ে এসেছে।ছেলেটা যখন একটু বড় হল,যখন হাটতে শিখলো তখন তার আঁচল ধরে ধরে সে যেদিকে যায় সেদিকে যাচ্ছে।আবার কোন এক ঝুম বর্ষণের দিনে সে আর তার স্বামী মাঝখানে তার ছেলেটাকে বসিয়ে তাদের ঘরে বাংলা সিনেমা দেখছে।
এরকম স্বপ্ন সে তার উনিশ বছরের জীবনে বুঝতে শেখার পর থেকে কতবার যে দেখেছে তার কি কোন ইয়ত্তা আছে?নিশি কিংবা জাগরণ সেখানে কোন ব্যবধান তৈরী করতে পারেনি!
স্বামীর কথা মনে হতেই কুসুমের মন খারাপ হয়ে গেল।
"আহা...বেচারা এই রইদের মইধ্যেও রিকশা চালাইতাছে।কোন সময় যে খাইতে যাইব।তার নতুন বউ কি তারে ঠিকমত খাইতে দিতে পারব?ওই মাইয়া কি আর মানুষটার পছন্দ-অপছন্দ জানে?"
মনে মনে ভাবল কুসুম।নিজের অজান্তেই তার ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসলো।
ওই ছেলেটা এখনও তার দিকে তাকিয়ে আছে।নয় দশ বছর বয়স হবে ছেলেটার।পড়নে একটা ছেঁড়া লাল টিশার্ট আর ময়লা একটা প্যান্ট। উস্কখুস্ক চেহারা।
কুসুম ছেলেটাকে ডাকল-
-"এই পোলা এইদিকে আয়।" ছেলেটা গুটিগুটি পায়ে কুসুমের দিকে আসছে। তার হাতে প্যাকেট দুইটা।
-"ডাকেন ক্যান?" কুসুমের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ছেলেটা।
কুসুম বলল-
-"তোর কোন কাম-কাজ নাই?এইখানে সারাদিন ধইর্যা দাঁড়াইয়া আছস। ঘরে যাস্ না ক্যান?"
-"আমার ঘর নাই।
-"ঘর নাই?তুই থাকস কই,তোর বাপ-মা কই?"
-"আমার বাপ-মা নাই।" স্পষ্ট উত্তর দেয় ছেলেটা।
এই ছেলে রাস্তার ছেলে বুঝাই যাচ্ছে।এদের যেমন ঘর থাকে না, তেমনি অনেকের বাবা মাও থাকে না।আর থাকলেও সন্তানের খোঁজ তারা রাখে না।
এই বাচ্চাগুলো সারাদিন পথে পথে কাজ করে আর রাতে ক্লান্ত হয়ে এই শহরের কোন এক ফুটপাতে কিংবা ওভারব্রিজে কিংবা রেলস্টেশনে শুয়ে পড়ে।
এ পৃথিবী বড় বড় শহর বন্দরে এদের খোলা জায়গায় শোয়ার সুযোগ দিয়ে একান্ত আলিঙ্গনে নিয়েছে ঠিকই কিন্তু ছাদের নিচে চার দেয়ালের ছোট্ট একটা ঘরে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিতে নারাজ।এরা সেই স্পর্ধাও দেখায় না!
কুসুম মায়াভরা চোখে তাকিয়ে আছে ছেলেটার দিকে।তার খুব মায়া লাগছে ছেলেটার জন্য।হঠাৎ করে ছেলেটা তার হাতের একটা প্যাকেট কুসুমের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল-
-"এইডা লও।তোমার লাইগ্যা আনছি।"
-"এইডা কি?"
-" বিরানী।পাশেই একটা বাসায় কুলখানি আছিল।তোমার কথা কইয়া এক প্যাকেট নিয়া আসছি।তুমিতো মনে হইতাছে সকাল থাইক্যা কিছু খাও নাই?"
কুসুমের চোখ ভিজে উঠলো।নিতান্ত অপরিচিত এই ছেলেটা তার জন্য কি মমতাই না দেখাচ্ছে।সে হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা নিল।
-"তুমি খাও।আমি নিচ থাইক্যা তোমার জইন্য পানি নিয়া আসতাছি।"
এইটুকু বলেই ছেলেটা নিচে ওভারব্রিজের সিঁড়ি ধরে নামতে শুরু করল।কুসুমের চোখে পানি চলে আসলো।সে প্যাকেট খুলে গোগ্রাসে গিলতে লাগলো। তার প্রচণ্ড ক্ষিধে পেয়েছিল।তাছাড়া তার গর্ভের সন্তানটারও তো খাবার প্রয়োজন। পানি নিয়ে আসার পর কুসুম ছেলেটার নাম জেনে নিল।ওর নাম রাজু।
খুব তারাতারি ২য় পর্ব আসছে