এবার টাইগারদের ব্যাটিং কোচ হচ্ছেন জেমি সিডন্স

ক্রিকেট দুনিয়া December 16, 2021 3,212
এবার টাইগারদের ব্যাটিং কোচ হচ্ছেন জেমি সিডন্স

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ব্যর্থতায় চাকরি যাচ্ছে ডমিঙ্গো সহ প্রায় পুরো কোচিং স্টাফের। শুধু স্পিন কোচ হিসেবে টিকে গেছেন হেরাথ। তার সাথে ব্যাটিং পরামর্শকের দায়িত্ব পাওয়া অ্যাশওয়েল প্রিন্সকে ছেড়ে দিয়েছে বিসিবি। নিউজিল্যান্ড সফর শেষে দেশে ফিরেই নতুন কোচ নিয়োগ দিবে বিসিবি। জানা গিয়েছে টাইগারদের নতুন ব্যাটিং কোচ হবে জেমি সিডন্স। সিনিয়র ক্রিকেটারদের চাওয়াতেই সিডন্সকে আবারো ফিরিয়ে আনছে বিসিবি।


বিশ্বকাপের আগেই গুঞ্জন উঠেছিল সিডন্সকে ব্যাটিং কোচ করবে বিসিবি। কিন্তু সিডন্স রাজি না হওয়াতে সেটা হয়নি। তব এবার মোটামুটি সব কথা চূড়ান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে বিসিবির একটি সূত্র। সবকিছু ঠিক থাকলে বিপিএলের পর ফেব্রুয়ারিতে ব্যাটিং কোচ হিসেব বাংলাদেশে আসবেন সিডন্স।


উল্লেখ্য, ২০০৭ সালের ২৮ অক্টোবর বাংলাদেশের কোচ হিসেবে দায়িত্ব নেন জেমি। অস্ট্রেলিয়ান হলেও বাংলাদেশের জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন দারুণভাবে। ঢাকার রাস্তায় সস্ত্রীক রিকশায় ঘোরা, ধূপখোলা মাঠে গিয়ে শিশু-কিশোরদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলা, তাঁর ন্যাড়া মাথা নিয়ে গুলশানের দোকানিদের আগ্রহ—সবকিছুতেই খুঁজে পেতেন আনন্দ। অথচ সেই জেমি সিডন্স বাংলাদেশে থাকতে চেয়েও পারলেন না!


২০০৭-এর অক্টোবরে দায়িত্ব নিয়ে ২০১১-এর এপ্রিল পর্যন্ত ছিলেন বাংলাদেশ দলের সঙ্গে। সিডন্স থাকতে চেয়েছিলেন এরপরও। কিন্তু তাঁর সঙ্গে চুক্তি বাড়াতে রাজি হয়নি বিসিবি। এই অস্ট্রেলিয়ানকে নিয়ে সমালোচনা ছিল, তিনি নাকি জাতীয় দলে নিজের পছন্দের খেলোয়াড়ের প্রতি বেশি উদার এবং অপছন্দের খেলোয়াড়দের প্রতি কঠোর। বোর্ড কর্মকর্তাদের মুখের ওপর অপ্রিয় সত্য বলে দেওয়ার ‘বদ–অভ্যাস’টাও ছিল প্রবলভাবে। যে কোচ বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের মানসিকতা বদলে দিয়েছিলেন, তিনিই তাই হয়ে গেলেন ভীষণ অপছন্দের। সেটা এতটাই যে বিদায়ের বছর দুয়েক পর ব্যাটিং কোচ হয়ে বাংলাদেশে ফিরতে চাইলেও বিসিবির কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন অস্ট্রেলিয়া দলের সাবেক এই সহকারী কোচ।

অথচ বাংলাদেশ দলের সাবেক-বর্তমান সব ক্রিকেটারই এক বাক্যে স্বীকার করেন, বিশেষজ্ঞ ব্যাটিং কোচ হিসেবে সিডন্স অতুলনীয়।


মোহাম্মদ আশরাফুলের ব্যাক লিফট বদলানো থেকে শুরু করে তামিম-সাকিবের কানে ম্যাচ জেতানো ইনিংস খেলার মন্ত্র প্রথম পড়ে দিয়েছিলেন তিনিই। সিডন্সের প্রশংসা শোনা যায় অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তি লেগ স্পিনার শেন ওয়ার্নের কণ্ঠেও। তাঁর দেখা সেরা ৫০ ক্রিকেটারের একজন সিডন্স। বলা হয়ে থাকে, কখনো টেস্ট ক্রিকেট খেলেননি, এমন ক্রিকেটারদের মধ্যে অন্যতম সেরা বাংলাদেশের সাবেক এই কোচ। বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন ছিল সিডন্সের চোখে। বহির্বিশ্বে এ দেশের ক্রিকেটের ইতিবাচক বিজ্ঞাপনও কম করেননি। বাংলাদেশ তখনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বড় দলগুলোকে বলে-কয়ে হারানো শুরু করেনি।


অথচ ২০১০ সালে নিজ দেশ অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে সিডনি মর্নিং হেরাল্ডকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সিডন্স বলে ছিলেন, সাকিব আল হাসান আর তামিম ইকবাল নাকি চোখ বন্ধ করে অস্ট্রেলিয়া দলে খেলতে পারেন। ‘ডিনামাইটের মতো কয়েকজন খেলোয়াড় আছে আমাদের (বাংলাদেশ) দলে। সাকিব অস্ট্রেলিয়া দলে ছয় নম্বরে ব্যাট করতে পারে, হতে পারে তাদের এক নম্বর স্পিনারও। আর শেন ওয়াটসনের সঙ্গে তামিম ইকবাল অনায়াসেই ওপেন করতে পারে’—বাংলাদেশের দুই খেলোয়াড়ের ব্যাপারে এই ছিল তাঁর মূল্যায়ন।


‘কড়া হেড মাস্টার’ ডেভ হোয়াটমোর বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের বীজ বুনে দিয়ে গিয়েছিলেন। সে বীজ থেকে চারা গজাল এবং সিডন্সের যত্নেই একটু একটু করে পাতা ছড়ায় সেগুলো। ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশ দলের আজকের যে চেহারাটা সবাই দেখছে, সেটা তো ফুটতে শুরু করেছিল তাঁর সময়েই! তাঁর কোচিংয়ে ৮৪টি ওয়ানডে খেলে ৩১টিতে জয় পায় বাংলাদেশ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে জেতে দুটি টেস্টও। তবে সিডন্সকে সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব দিতে হবে আইসিএল-কাণ্ডের পর বাংলাদেশ দলকে সাহসিকতার সঙ্গে পুনর্গঠিত করার জন্য।


২০০৮ সালে বাংলাদেশের ১৪ ক্রিকেটার একসঙ্গে ভারতের বিদ্রোহী লিগ আইসিএলে চলে যান। অভিজ্ঞ ক্রিকেটারের সংকট তো হয়েছিলই, দল গঠন করাটাই মুশকিল হয়ে পড়ে তখন। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্যি, চরম ওই সংকটে পড়ার পর প্রথম ম্যাচেই বিশ্ব ক্রিকেটে হইচই ফেলে দিল বাংলাদেশ দল। মিরপুরে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে হোম সিরিজ শুরু করল জয় দিয়ে। সিডন্সের সময়ই পরে নিউজিল্যান্ডকে আরও বড় নাকানি-চুবানি খাইয়েছে বাংলাদেশ। ২০১০ সালে ঘরের মাঠের ওয়ানডে সিরিজে দিয়েছে ৪-০–এর লজ্জা।


সিডন্সের চার বছরের মধ্যে সবচেয়ে আলো ঝলমলে বছরটাও এসেছে আইসিএলের ঘটনার পরই। ওয়েস্ট ইন্ডিজ, শ্রীলঙ্কা ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২০০৯ সালে মোট ১৯টি ওয়ানডে খেলে ১৪টিতেই জয়। টেস্টেও একই চিত্র। তিন ম্যাচে জয় দুটিতেই। ২০১০ সালে ব্রিস্টলে ও ২০১১ এর বিশ্বকাপে।


ইংল্যান্ডকে দুবার হারানোর সাফল্যও যোগ করতে হবে সিডন্সের অর্জনে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে গিয়ে ঐতিহাসিক সিরিজ জয় তো আছেই। এত সাফল্যের সঙ্গে কাটা হয়ে থাকবে শুধু ২০১১–এর বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৫৮ ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৭৮ রানে অলআউট হওয়ার লজ্জা।


সাফল্য-ব্যর্থতার হিসাব করলে সিডন্সের সাফল্যের পাল্লাটাই বেশি ভারী। তবে বাংলাদেশের কোচ হিসেবে তাঁর সবচেয়ে বড় সাফল্যটা কোনো পরিসংখ্যানের পাতায় খুঁজে পাবেন না। বদলে যাওয়া বাংলাদেশের অদৃশ্য বাটনটা তো তিনিই তুলে দিয়ে গিয়েছিলেন পরবর্তী কোচদের হাতে। এখন অদৃশ্য জিনিস আপনি দেখবেন কীভাবে!