প্রতিদিন কঠোর পরিশ্রমের পর আপনি যে অর্থ উপার্জন করেন তা থেকে দৈনন্দিন ব্যয় বহনের পর যে অর্থ বাকি থাকে তা এমন কাজে ব্যয় করা উচিত যাতে আপনি সুখী হবেন। বিজ্ঞান বলে ওই অর্থ চাহিদার অতিরিক্ত কোনো ভোগ্য বস্তুর পেছনে নয় বরং অভিজ্ঞতার পেছনে ব্যয় করলেই আপনি বেশি সুখী হবেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. থমাস গিলোভিচ ২০ বছর ধরে গবেষণার পর একটি শক্তিশালী এবং সোজাসাপটা উপসংহারে পৌঁছেছেন। তিনি বলেন, ভোগ্য বস্তুর পেছনে বেশি অর্থ ব্যয় করবেন না। কারণ ভোগ্য বস্তু আপনাকে যে সুখ সরবরাহ করবে তা দ্রুতই মিলিয়ে যাবে। এর তিনটি গুরুতর কারণ আছে...
১. আমরা সহজেই নতুন বস্তুর মালিকানায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ি। ফলে একসময় যা অনেক বেশি আকর্ষণীয় এবং উত্তেজনাকর মনে হতো তা দ্রুত গতানুগতিক জিনিসে পরিণত হয়।
২. নতুন বস্তু কেনার পর ফের নতুন প্রত্যাশা তৈরি হয়। আমরা যখন কোনো নতুন জিনিসের মালিকানায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ি তখন আমরা আরো ভালো কিছু চাই।
৩. ভোগ্য বস্তুরা সব সময়ই স্বভাবগতভাবেই অন্যের সঙ্গে তুলনা উস্কে দেয়। আমরা যখন একটি নতুন গাড়ি কিনি তখন আমরা সেটি নিয়ে উত্তেজিত থাকি। কিন্তু কোনো বন্ধু যখন এর চেয়েও ভালো একটি গাড়ি কিনে তখন তার সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে সেই উত্তেজনাটুকু আর থাকে না।
ভোগ্য বস্তু থেকে বিরামহীনভাবে সুখ পাওয়ার পথে প্রধান বাধাটি হলো অভ্যস্ততা। আমরা সুখী হওয়ার জন্য নানা ভোগ্য বস্তু কিনি। এবং এতে আমরা সফলও হই। কিন্তু তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। নতুন জিনিস প্রথমে আমাদের কাছে বেশ উত্তেজনাকরই মনে হয়। কিন্তু এরপর আমরা তাতে অভ্যস্ত হয়ে যাই।
কোনো ভোগ্য বস্তুর মালিকানার ধাঁধাটি হলো, আমরা ধারণা করি যে, আমরা হয়ত ততক্ষণই সুখী হব যতক্ষণ ওই বস্তুটি টিকে থাকবে। আমরা ভাবি যে, যা স্থায়ীভাবে দেখা যায়, শোনা যায় এবং স্পর্শ করা যায় তার পেছনে অর্থ ব্যয় করলে আমরা সবচেয়ে বেশি সুখী হব। কিন্তু এটা ভুল।
অভিজ্ঞতার শক্তি
অধ্যাপক ড. থমাস গিলোভিচ এবং অন্যান্য গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন, যত ছোটই হোকনা কেন অভিজ্ঞতা মানুষকে আরো বেশি দীর্ঘমেয়াদি সুখ এনে দেয়। কারণ...
১. অভিজ্ঞতা আমাদের আত্মপরিচয়ের অংশ হয়ে ওঠে। আমাদের মালিকানায় থাকা বস্তুই আমাদের পরিচয় নয়। বরং আমাদের আত্মপরিচয় গড়ে ওঠে আমরা যা কিছু দেখেছি, যা কিছু করেছি এবং যেসব স্থানে ছিলাম সেসবের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার মধ্য দিয়ে।
একটি দামি ঘড়ি কিনলে আপনার আত্মপরিচয় বদলে যাবে না। কিন্তু কাজ থেকে বিরতি নিয়ে পাহাড়ে বা সমুদ্রে ভ্রমণে গেলে হয়তো নতুন কোনো অভিজ্ঞতার আলোকে আপনি বদলেও যেতে পারেন।
আমাদের অভিজ্ঞতাগুলো আমাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের মালিকানায় থাকা বস্তু আমাদের থেকে আলাদাই রয়ে যায়। আমাদের জীবনব্যাপী অর্জিত অভিজ্ঞতাগুলোর সমন্বয়েই আমরা গড়ে উঠি।
২. আমরা বস্তুর মতোই অভিজ্ঞতার তুলনা করি না। দুটি অভিজ্ঞতার মধ্যে আসলে কোনো তুলনা সম্ভব নয়। আর এ কারণেই অভিজ্ঞতা বস্তুগত ভোগ্য পণ্যের চেয়ে অনেক বেশি উপভোগ্য হয়।
৩. অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে পূর্বানুমান উত্তেজনা এবং আনন্দ বাড়িয়ে তোলে। অথচ কোনো বস্তুর মালিকানা অর্জনের অনুমান সেটি পেতে ব্যগ্রতা বাড়ায়। অভিজ্ঞতাগুলো পরিকল্পনা শুরুর প্রথম মুহূর্ত থেকেই উপভোগ্য হয়ে ওঠে।
৪. অভিজ্ঞতাগুলো হয় ভাসমান, আর এটা ভালো। কারণ কোনো বস্তু কেনার পর তা আমাদের মনোঃপুত না হলে আমরা অনবরত পীড়িত হই। যতক্ষণ ওই বস্তুটির অস্তিত্ব থাকে ততক্ষণই তা আমাদেরকে পীড়া দিতে থাকে। কিন্তু অভিজ্ঞতাগুলো তেমন নয়। কারণ অভিজ্ঞতা খুব অল্প সময়ের জন্য বিরাজমান থাকে। আর এ কারণেই আমরা আমাদের অভিজ্ঞতাগুলোকে এতটা মূল্য দিয়ে থাকি। আর সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সে মূল্য বাড়তে থাকে।